অপারেশন কাঁকনপুর - আলী ইমাম - ইনফোক্রাঞ্চ - ছড়িয়ে পড়ুক নতুন কিছু জানার আগ্রহ

সর্বশেষ পোস্ট

ইনফোক্রাঞ্চ - ছড়িয়ে পড়ুক নতুন কিছু জানার আগ্রহ

ছড়িয়ে পড়ুক নতুন কিছু জানার আগ্রহ

test banner

Post Top Ad

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Tuesday, November 28, 2017

অপারেশন কাঁকনপুর - আলী ইমাম


এক সময় ভাবতাম বাংলাসাহিত্যে কিশোর উপন্যাসের সংখ্যাটা তুলনামূলক কম। আসলেই কি কম ? কত কম...? এর উত্তরটা একবাক্যে দেয়া সম্ভব না।কেননা কত টুকুই বা পড়তে পেড়েছি কৈশোরে ! আর কত টুকুই বা জানতাম সে সময় ! 

আমাদের কাছে পছন্দের কিশোর উপন্যাস বলতে প্রথমেই মনে পড়ে, রকিব হাসানের - তিনগোয়েন্দা বা জাফর ইকবালের কিছু উপন্যাস। 
কিন্তু সত্য বলতে এর বাহিরে আরো একটি নাম উঁচু বুকে ঢুকে যেতে পারে এই তালিকায়। তিনি হলেন 'আলী ইমাম'। এবং তার উপন্যাস 'অপারেশন কাঁকনপুর'।

সকলের আড়ালে চাপা পড়া এই লেখক লিখে গেছেন পাঁচশ এর বেশি কিশোর উপন্যাস। এরমধ্যে অন্যতম কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ 'পিকু'। ছোট ছোট তিনটি উপন্যাস - অপারেশন কাকনপুর, রক্তমাখা পুথি, কুঠিবাড়ি রহস্য নিয়ে এই সিরিজ। আমার কাছে সিরিজের সবথেকে পছন্দের বই 'অপারেশন কাঁকনপুর'। 





মাত্র ৪৪ পেজের একটা উপন্যাস 'অপারেশন কাঁকনপুর'।
গল্পের মূল চরিত্র মা মরা ছেলে পিকু। যাকে বইয়ের পাতায় আর দশটা গোয়েন্দার থেকে একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন আলী ইমাম। অন্তত আমার তাই মনে হয়। পিকুর মধ্যে রহস্য উন্মোচনের প্রবণতা আছে ঠিকই। কিন্তু তার বেশি আগ্রহ প্রকৃতির নিখাদ রূপ পর্যবেক্ষণে। এই দিকটাই অন্য সবার থেকে আলাদাভাবে তুলে ধরে পিকুকে। 

দুই মলাটের মাঝের পাতাগুলোতে সাধারণ বাঙ্গালী এক কৈশোরের চিত্রায়ন করেছেন আলী ইমাম। যা মিলে যায় প্রকৃতিপ্রেমী যে কারোর ফেলা আসা শৈশবের সাথে। যে কিশোর বাবার বদলীতে অন্য জায়গায় পাড়ি জমালেও, মনের জায়গা থেকে সরাতে পারেনা ফেলে আসা বন্ধুদের। বারবার আকুলতা দেখায় জমিয়ে রাখার স্মৃতির প্রতি।

সাবলীল ছোট ছোট বাক্যে, বিমুগ্ধ সব উপমায়, সুনিপুণ হাতে অতুলনীয় এক উপন্যাস রচনা করেছেন আলী ইমাম। কোনো জায়গায় অতিমানবীয় রূপ না দিয়ে, সাদামাটা এক কৈশোরের গল্পই তুলে এনেছেন বইয়ের পাতা জুড়ে। যা উঠতি বয়সী যেকোনো পাঠককে কাঁকনপুরে হারিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য। 

কাহিনী সংক্ষেপ


পিকুর বাবা ফরেস্ট অফিসার হওয়ায় বদলীর চাকরী। ছুটে বেড়ান এ শহর থেকে ও শহর। সাথে থাকে পিকু। এবারে বদলী হয়েছে কাঁকনপুরে। 

পথে আসতে আসতে নিঃশব্দ কাঁকনপুরে অবারিত রূপ বিমোহিত করে ফেলে পিকুকে। তাই তার বাবা অফিসে চলে গেলে, সুযোগে বুঝে মংলিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। মংলি সাঁওতালদের ছেলে। পিকুদের নতুন বাসায় রান্নার কাজ করে।

ঝার্না, বুন ঝোপঝাড় এসব ডিঙ্গিয়ে পাহাড়ের দিকে হাটতে থাকে তারা। হঠাৎ ঝোপ থেকে সাৎ করে কি যেন সরে যেতে দেখে পিকু। ঝোপটার কাছে পৌছে দেখলো একটা পোড়া সিগ্রেট পড়ে আছে। এদিকওদিক চোখ ফেরাতে দেখতে পেলো, ট্রেনের সেই লোকটা। যে তাকে ফ্যাসফ্যাসে গলায় গল্প বলে চমকে দিয়েছিল। আর তাকে বিষাক্ত কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে এখানে কি করে আসবে? সে তো চুপ করে এক স্টেশন আগে নেমে গিয়েছিল। আর এখন এই অন্ধকার ঝোপে বসে কি করছিল সে? 

পরেরদিন রাতে গেট খোলার চেষ্টা করছিল কেউ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ল্যাম্পের আলোয় ট্রেনের সেই আজগুবে বুড়ো লোকটাকে দেখতে পেল পিকু। সাথে সাথে চিৎকার দিতেই পালিয়ে যায় লোকটা।
রাতে ভালো ঘুম আসেনা আর। কেনো এই লোকটা তাদের পিছু নিয়েছে? কেনো লুকিয়ে তাদের ফলো করছে? অনেক ভেবেও উত্তর পায়না পিকু। কিন্তু রহস্য রহস্য একটা গন্ধ পেয়ে যায় ঠিকই। 

কাকনপুরে সাঁওতালদের একটা বস্তি আছে।পাহাড়ের কাছে। নাম 'বাঘমুন্ডী'। ওখানে থাকে মংলিরা। প্রতি বছরে একবার উৎসব হয় ওখানে। ওদের গ্রামের সবচেয়ে পুরনো গাছের কোঠরে রাখা হয় সোনার হাসের মূর্তি।সারা বছর কেউ খোজ পায়না হাসটার। সর্দারের কাছে লুকনো থাকে। শুধুমাত্র উৎসবের দিনে গ্রামের সবচাইতে পুরনো গাছের কোঠরে এনে রাখা হয় হাসটা । তাকে ঘিরে গোল করে নাচে সাঁওতালরা। এই উৎসব দেখতে মংলিকে সাথে নিয়ে ওদের গ্রামে যাচ্ছে পিকু। 

হঠাত পথে দেখা হয় ক্যানারি সাহেবের সাথে। ক্যানারি দ্বীপে অনেকদিন ছিল বলে এমন নাম। কাঁকনপুরের জনপ্রিয় লোকদের একজন তিনি। কিছু কিছু লোক আছে, তারা যখন বলে, তখন মনে হয় কথার তুলি দিয়ে ছবি আঁকছে। তিনি হচ্ছেন সেই ধরনের লোক। 
পিকু বাঘমুন্ডি যাচ্ছে শুনে চমকে উঠলেন ক্যানারি সাহেব। যেতে নিষেধ করলেন পিকুকে। চেষ্টা করলেন ভয় দেখাবার। ক্যানারি সাহেবের এই আচরণের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলোনা পিকু। 

বিকেলের দিকে সাঁওতালী গায়ে পৌছে যায় ওরা। একটা সময় গোধূলিকে বিদায় দিয়ে, মস্ত গোল চাঁদ উঠে যায় আকাশে। সর্দার এসে গাছের কোঠরে রাখে সোনার হাস। ঠিক তখনি ঘটনাটা ঘটে গেল বাঘমুন্ডি'তে। পরপর দুবার গুলির শব্দ। যে যার মতো ছুটে পালাতে লাগল। সুযোগ বুঝে কালো কাপড় জড়ানো দুটো লোক হাসটা তুলে নিয়ে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু বিড়াল আক্রমণ করলো একজনকে। শেষমেশ পালাতে পারলেও, বয়ে নিয়ে গেল বিড়ালের আঁচড়ের ক্ষত। 

এমন ঘটনা ঘটে যাওয়াতে বাঘমুন্ডী'র সকলের মন খারাপ। চাপা কষ্ট অনুভব করে পিকু নিজেও। বিষণ্ণ হয়ে থাকে সব সময়। এমন একটা দিনে ক্লু ধরা পরে খুদে রহস্যপ্রিয় পিকুর চোখে। সেটা ধরেই সে নেমে পরে গোয়েন্দাগিরি'তে। 


পাঠ-প্রতিক্রিয়া



ছোটবোন আমার থেকেও বেশি বই পড়ে। পিচ্চি বয়সে সে বাসার খাটের নিচে থাকা ট্রাঙ্ক খুলে সব বই পড়ে ফেলেছে। এরমধ্যে কঠিনীয়া ভাষায় লিখা শ্রীকান্ত'ও আছে। আমি বয়সে বড় হলেও এইসব বই ধরার সাহস করিনি। মনে মনে চিন্তা আরো বড় হই। তখন পড়ব।

এরমধ্যে একটা বই ওকে প্রায় পড়তে দেখি। আর শুনি মনপ্রাণ ঢেলে প্রশংসা করতে। তাই একদিন হাতে নিলাম বইটা। দেখি কভার টভার কিছু নেই। পেজ গুলিনো খোলা। আলাদা আলাদা হয়ে আছে। এমন বই পড়ার রুচি হয়না। তাই সে যতই ভালো বলুক। সেবার পড়া হলোনা।

কিছুদিন পরে পড়ার মতো কোনো বই হাতে নেই। কিন্তু মনের খোঁড়াক মেটাতে বই চাইই চাই।তো, কোনো উপায় না পেয়ে শেষমেশ সেই ছেড়া বইটাই শুরু করে দিলাম।

আলী ইমামকে চিনতাম পাঠ্যবইয়ের একটা প্রবন্ধ পড়ে। নাম মনে নেই। কিন্তু মনে ছিল একদম ভালো লাগেনি লিখাটা। কিন্তু 'অপারেশন কাঁকনপুর' এর প্রথম লাইন থেকে ধারণা বদলে যেত লাগলো। নিজেকেই বারবার বলতে ইচ্ছে করলো, এতদিন কেনো পড়িনি এই বই। কেনো পড়িনি! কেনো !

আহা কি মায়াময় একেকটা শব্দের বুনন। কি অদ্ভুত মুদ্ধতা ঘিরে ধরে পড়বার সময়। টেনে নিয়ে যায় দূর..... বহুদূর। হয়ে যাই গল্পের পিকু। উঠে পড়ি ছুটতে থাকা ট্রেনে। যার গন্তব্য কাঁকনপুর। চোখের সামনে ভেসে আসে কুলিদের 'চা গ্রাম, চা গ্রাম'। শুনতে পাই ট্রেন গুম গুম শব্দে ব্রিজের উপর দিয়ে চলছে। মুদ্ধ চোখে দেখি, নদীর বুকে আলতো করে ভেসে বেড়াচ্ছে ধূসর বরণ গাঙচিল। নীল অপরাজিতার মতো আকাশ ঝলমল করছে লাল রোদে। ডুবে যাই কাঁকনপুরের স্নিগ্ধ বর্ণানায়।

চাদের সাথে আমি দেবনা... তোমার তুলনা ......। এদেশে এক সময়ের জনপ্রিয় গান। প্রেয়সীর রূপকে আলাদাভাবে একটা স্থান দেয়া হচ্ছে গানটাতে। যেই রূপকে চাদের সাথেও তুলনায় আনতে চায়না গাতক। 
ঠিক তেমনি 'অপারেশন কাঁকনপুর' কে, অন্য কোনো কিশোর উপন্যাসের সাথে তুলনা করবোনা।তপু, রাশেদ, দীপু ;কিংবা কিশোর, রবিন, মুসা কারো সাথে না। পিকু আলাদা একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। এবং সেটা অতুলনীয়। 

বইয়ের শুরুটা এক অদ্ভুতুড়ে রহস্য দিয়ে শুরু এবং শেষটা রহস্যভেদ কাহিনী হলেও, পুরো বই জুড়ে ছিল প্রকৃতির বিবর্ণ, নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ রূপের মোহময় বর্ণনা। যা পাঠককে নিজের স্থান থেকে সরিয়ে স্বপ্নলোকে ভাসিয়ে দিতে সক্ষম। 

যেসব কিশোর পড়ুয়া স্বপ্নে ভেসে বেড়াতে পছন্দ করে। হারিয়ে যেতে চায় প্রকৃতির পথে পথে। মুদ্ধ হয় ধরনীর অপার সৌন্দর্যে। এই বই তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।





লেখক
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার
আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Responsive Ads Here