কোনদিন যদি আলাদীনের দৈত্য এসে জিজ্ঞেস করতো "আমার তিনটি ইচ্ছা কি?" আমি বলতাম- তিনটি নয়, আমার একটি মাত্র ইচ্ছা আছে। আর সেটা হল আমি আমার সারা জীবনের বিনিময়ে "এইসব দিনরাত্রি"র মতো একটি উপন্যাস লিখতে চাই।কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল-আলাদীনের দৈত্য আমাদের কাছে আসে না,আসে হুমায়ূন আহমেদদের কাছে।তাদের আবার কৃপণের মত শুধু তিনটি করে ইচ্ছা পূরণ করে না,করে অনেক।আর তার ফলেই তাদের কাছ থেকে আমরা পাই অসাধারণ সব লেখা যেগুলো পড়ে আমরা হাসি,আমরা কাঁদি,সংসারের যাঁতাকলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে জীবনিশক্তি ফিরে পাই,ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জন্ম হয় আমাদের।"এইসব দিনরাত্রি" তেমনই একটি বই।বইয়ের শুরুতে প্রকাশক লিখেছেন "এইসব দিনরাত্রি" মধ্যবিত্ত জীবনের সাধারণ হাসি-কান্নার গল্প।কিন্তু এ তো সাধারণ নয়।একটা "অ" আছে সামনে-অসাধারণ।
আমি যতবার "এইসব দিনরাত্রি" পড়ি,পড়ে ভাবি-যদি রফিক-সফিকের বাবার মতো আমার বাবা হতেন! অসুখক-বিসুখ হলে নিজেই হোমিওপ্যাথি করে "আর্নিকা টু" নিয়ে হাজির হতেন।নিয়ম মেনে "আর্নিকা টু" খেতাম আর তার গুণাবলী শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেতো।অসুখ হয়তো ভালো হতো না কিন্তু প্রাণ খুলে হাসতে পারতাম।বই পড়েই যে হাসি হেসেছি,সত্যিই যদি কেউ চোখের সামনে "আর্নিকা টু" নিয়ে নাচানাচি করতো তাহলে আমার যে কি অবস্থা হতো কে জানে! হয়তো হাসতে হাসতে এমন অবস্থা হতো যে লোকে আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলত আর আমার আব্বা নতুন উৎসাহে কেস হিস্ট্রি ঘাটতে ঘাটতে "কেরিমিন ফাইভ হান্ড্রেড" নিয়ে হাজির হতেন(ঔষধের এই নামটি আমার বানানো,দয়া করে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না)।
মাঝে মাঝে ভাবি,যদি "মাস্টার মামার" মতো আমিও এরকম একজন মহাপুরুষের দেখা পেতাম যার পাশে বসলেও পুণ্য হয়,মন পবিত্র হয়।সারাজিবন এমন এক জীবন কাটিয়ে যাই যেখানে সেই জীবনে নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় নেই। যেমনটি হতে পেরেছিল নীলু, সফিকের স্ত্রী। রফিকের ভাবী। কিন্তু সেসব কেবল স্বপ্নেই আসে,বাস্তবে না।হুমায়ূন আহমেদ তাঁর উপন্যাসে এমন কিছু চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যা কেবল তাঁর উপন্যাসেই বিদ্যমান।উনি নিজেও হয়তো এরকম কারও দেখা পান নি কিন্তু এরকম কারও সাহচর্য প্রত্যাশা করেছেন।তাই বাস্তবে না হলেও উনার লেখনীর মধ্য দিয়ে উনি উনার পাঠকদের সেরকম কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ আমার চিন্তা চেতনার ভিত্তিমূল এমন ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছেন যে আমি এখন সোজাভাবে আমার মতো করে কিছু ভাবতে পারি না।নতুন কোন কিছুর মুখোমুখি হলে নিজের মতো চিন্তা করা বাদ দিয়ে ভাবি এরকম ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের অমুক চরিত্র কি ভাবতো বা কি করতো?নিজের অজান্তেই সেরকম করেই কাজ করা শুরু করি।এতে পরিচিত মহলে প্রায়ই হাসির পাত্র নতুবা কৌতূহলের খোরাক হই।হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ চরিত্রই রসিকতায় পারদর্শী হওয়ায় আমার ঐদিক টি বেশি উন্নত হয়েছে।রফিকের মতো যেখানে সেখানে রসিকতা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।কিন্তু তাতে কি?আমার একটা দিন যাবে,আরেকটা রাত্রি আসবে কিন্তু সেখানে "এইসব দিনরাত্রির" কোন চিহ্ন থাকবে না তা কি হয়?
অনেক হাসি তামাশার কথা বললেও "এইসব দিনরাত্রির" মূল সুরটি কিন্তু বিষাদের-এবং এর জন্যই কিন্তু "এইসব দিনরাত্রি" আমার এতো প্রিয়।কেননা আমাদের মধ্যবিত্তদের প্রাত্যহিক জীবনে সুখের স্থানই বা কতোটুকু?হুমায়ূন আহমেদ পাঠকদের এই মানসিকতা বুঝতেন বলেই হয়তো বিষাদের সুরে এমন কিছু উপন্যাস লিখে যেতে পেরেছন যেগুলো পড়লে হাসতে হাসতে বার বার চোখ মুছতে হয়। বুকের ভেতরের জমানো সেই কবেকার দুঃখ কষ্ট গুলো হাচড়ে পাছড়ে গলা দিয়ে চোখ দিয়ে বের হতে চায়।"এইসব দিনরাত্রি" আবার তাদের মাঝে লিডিং পজিশনে।
কেউ যদি আমাকে আমার পড়া সেরা তিনটি উপন্যাসের নাম জিজ্ঞেস করে তবে "এইসব দিনরাত্রি" কে আমি দু' নম্বরে স্থান দেবো।মধ্যবিত্ত জীবনের আশা-আনন্দের গল্প বলে এক থেকে তিন এই ক্রমিকের মাঝখানেই স্থান দিলাম। হা....হা.......হা।
কবি জীবনানন্দ দাস কে কিন্তু একটি ধন্যবাদ দিতেই হয়।"এইসব দিনরাত্রি" নামে তিনি যে কবিতা টা লিখেছিলেন সেটা যেকোনো কবির কাছেই আরাধ্য।হুমায়ূন আহমেদ হয়তো তাঁর প্রিয় কবির কবিতাটার সাথে পাল্লা দিয়ে "এইসব দিনরাত্রি" উপন্যাসটি লিখেছিলেন। ফলাফল? কেহ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান।
এই রিভিউ-এ আমি ইচ্ছে করেই একটা বিষয় এড়িয়ে গেছি। কেন এড়িয়ে গেলাম এবং কি এড়িয়ে গেলাম তা যদি আপনি বইটা পড়ে থাকেন তবে নিশ্চই বুঝতে পারছেন। নয়তো বইটি পড়ে বুঝতে হবে।
বইয়ের রিভিউ কীভাবে লেখে আমি জানি না,কোন শর্ত বা নিয়ম মেনে লিখতে হয় কি না তাও জানি না।শুধু জানি "এইসব দিনরাত্রি" পড়ার সময় যে ভয়াবহ মুগ্ধতা আমাকে গ্রাস করেছিল তা কেবল কালির কলমে ধরতে চেয়েছি, কিন্তু তা আর পারলাম কই?
No comments:
Post a Comment