আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে থাকা উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা "মেমসাহেব"। বইয়ের গ্রুপগুলোতে কমপক্ষে দশটি রিভিউ এবং প্রায় সমসংখ্যক প্রশংসা ও নিন্দামূলক মন্তব্যগুলো পড়ার পর বইটা পড়ার কৌতুহল সংবরণ করা অসম্ভব ছিল। অবশেষে পরিচিত হলাম মেমসাহেবের সঙ্গে। যারা চেনেন না আসুন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
কাহিনী সংক্ষেপ
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
ট্রেনের কামরায় দুটি প্রাণীর চার চোখের চোরা চাহনির মিলন সূচনা করেছিল এক ইতিহাসের। সে ইতিহাস এক মেমসাহেবের। বব কাট চুল আর ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক দেয়া কোন ইংরেজ মেম নয়, রীতিমত শাড়ি পরা সে এক বাঙালি মেমসাহেব।
জন্মের পর পরই বাচ্চুর মা পাড়ি জমিয়েছিলেন অনন্তের পথে। সেই ছোট্টটি থেকে বড় হতে কোন নরম কোমল উষ্ণতার আশ্রয় তার কপালে জোটে নি। আদর করবার জন্য না হোক শাসন করবারও কেউ ছিল না তার। একবেলা খেয়ে অথবা দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়ে জীবন চলেছে। দুবেলা দুমুঠো খাবার জুটানো আর একটা মাথা গোজবার আশ্রয় জোগাড় করা ছাড়া কোন প্রবৃত্তি জন্ম নেবার অবকাশ পায় নি।
তবে বাচ্চু ভিখারী ছিল না। তার মধ্যে ছিল পরিশ্রম করবার মন, সততা এবং আত্মমর্যাদা। ছিল না শুধু স্বপ্ন আর বড় হবার সাহস।
এই ছন্নছাড়া মানুষটির জীবনে মেমসাহেব এল বসন্তের দোলা দিয়ে। মেমসাহেব কেবল একতাল মাংসের ডেলা ছিল না। রিপোর্টারের জীবনে তার আগমন ছিল জীবনীশক্তিরুপে। যার পরশে ও প্রেরণায় প্রেমে, রুপে, রসে বাচ্চুর অতি সাধারণ জীবন অসাধারণ সৌন্দর্যে ও সাফল্যে ভরে উঠেছিল। তার নিখাঁদ ভালবাসায়- বন্দী করবার ছলনা ছিল না; ছিল মুক্তির স্বাদ আর মাথা উঁচু করা মহান মানুষগুলোর মাঝে প্রিয়তমকে দেখার সাধ।
উপন্যাসটি মূলত দোলাবৌদির কাছে লেখা ২০৭ পৃষ্ঠার চিঠি। যার উপজীব্য বিষয়ই হল মেমসাহেব এবং তার সঙ্গে কাটানো দিনগুলির তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনার বর্ণনা।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
নিঃসন্দেহে এটি একটি রোমান্টিকধর্মী উপন্যাস। কাগজের রিপোর্টার আর কম বয়সী অধ্যাপিকার প্রেমই এর মূখ্য বিষয়। বইটি উপন্যাস হবার চেয়েও যেন সিনেমার চিত্রনাট্য হবার পক্ষে বেশি উপযুক্ত। পাত্র-পাত্রীর মুখের সংলাপগুলোও যেন লেখক তৈরি করেছেন সে কথা ভেবেই। তাই ২০৭ পৃষ্ঠার বইটা পড়েও যখন মন ক্ষান্ত হতে চাইল না, দেখে ফেললাম আলোচ্য উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত মেমসাহেব মুভিটিও। বলাবাহুল্য, উপন্যাস ও মুভি দুই-ই প্রায় সমকালীন এবং লেখকের জীবদ্দশায় প্রকাশিত।
বৌদির কাছে দেবরের নিজের প্রেমকাহিনীর সবিস্তার বর্ণনা দিয়ে লেখা চিঠি হিসেবে এর ভাব, ভাষ্য ও মান যথোপযুক্ত মনে হয়েছে আমার কাছে। লেখনীর সরল ও সাবলীল গতিই বইটি পড়ার সময়কার আগ্রহ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একইভাবে অটুট রাখতে সাহায্য করেছে। নিজেকে দোলাবৌদির অবস্থানে ভাবতে বাধ্য করেছে।
অনেকেই এ বইটিকে লুতুপুতু বলে আখ্যা দিয়েছেন। আমার কিন্তু ভাবতে বেশ অবাক লাগছে, তারা প্রেমিক যুগলের প্রেমালাপটুকুই দেখলেন, মেমসাহেবের সাহস-ধৈর্য্য-শ্রম দেখলেন না! অধিকাংশ রোমান্টিক উপন্যাসগুলোতে দেখেছি পাত্র-পাত্রীর মিলন অথবা বিরহতেই উপন্যাস পরিণতির মুখ দেখে থাকে যেখানে নায়িকা নায়কের বাহুবন্ধনের ভিতর পৌছুনোর সাফল্য-ব্যর্থতাতেই কাহিনীর সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। কিন্তু এ বইয়ে মিলন বা বিরহকে ছাপিয়ে একটি সত্য আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে, আমার পড়া বইগুলোর আর কোন পাত্রী বা চেনাশুনো কোন রমনীকে আমি এতখানি সাহস, নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের সাথে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভালবাসতে দেখি নি। সে হিসেবে মেমসাহেব সকলের চেয়ে অনন্য। রিপোর্টারকে সে সমস্তটাই লাভ করেছিল আর এ বিষয়ে তার মধ্যে দ্বিধার লেশটুকুও ছিল না। মেমসাহেব লীলাময়ীর চাইতেও বেশি ছিল স্রষ্টা।
আরেকটি বিষয়, একটি সাধারণ ব্যক্তিগত চিঠিরুপে লেখক কেবলমাত্র একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ২০৭ পাতার চিঠি লিখেছেন যা শুধু কঠিনই নয়, রীতিমত দূরুহ একটি কাজ। মেমসাহেবের সমগ্র সত্তাকে লেখক তার লেখনীর গুণে পাঠকের কাছে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত করতে সক্ষম হয়েছেন, যা আমাকে অভিভূত করেছে।
শেষ কথা, আর যে যাই বলুক, তাকে শ্রেষ্ঠা যদি নাও বলি তবু মেমসাহেবকে ঘৃণা করবার মত সাহস আমার নেই।
"যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক,
তারা তো পারে না জানিতে
তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ
আমার হৃদয় খানিতে।"
No comments:
Post a Comment