মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুরা- পর্ব ১ - ইনফোক্রাঞ্চ - ছড়িয়ে পড়ুক নতুন কিছু জানার আগ্রহ

সর্বশেষ পোস্ট

ইনফোক্রাঞ্চ - ছড়িয়ে পড়ুক নতুন কিছু জানার আগ্রহ

ছড়িয়ে পড়ুক নতুন কিছু জানার আগ্রহ

test banner

Post Top Ad

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Saturday, December 30, 2017

মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুরা- পর্ব ১


যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশী নাগরিক না হওয়া সত্বেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন তাদের সম্মানার্থে বাংলাদেশ সরকার "মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা" - ভূষিত করেন ১২৯ জন আন্তর্জাতিক নাগরিক সংস্থাকে যার মধ্যে ৪৭ জন ভারতীয় ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান, ১১জন রাশিয়ান, ২২ জন মার্কিন, ১৪ জন ব্রিটিশ ব্যক্তিত্ব সংস্থা, জন জাপানিজ, জন জার্মান এছাড়াও নেপাল, ভিয়েতনাম সহ আরও ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিক সংস্থা।




ডব্লিউ এস ওডারল্যান্ড

 একাত্তরে অবদান রাখা বিদেশীদের মধ্যে একমাত্র বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত ব্যক্তি ডব্লিউ এস ওডারল্যান্ড মূলত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক হলেও তার জন্ম ১৯১৭ সালে নেদারল্যান্ডের অ্যামস্টাডার্মে। দারিদ্র্যতার কারণে ১৮ বছর বয়সে পড়াশুনা ছেড়ে মুচির কাজ করতে হয়েছিলো তাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি নেদারল্যান্ডের হয়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং জার্মান বাহিনীর হাতে ধরা পরেন। সেখান থেকে পালিয়ে এসে তিনি যুদ্ধের পরবর্তী সময় সেনা প্রশিক্ষক এবং গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন।


টঙ্গীস্থ বাটা সু কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৭০ সালে এবং ৭১   স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সমরে অংশগ্রহন করেন। একজন বিদেশী হিসেবে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে তাঁর গ্রহনযোগ্যতা বেশী থাকায় সব মহলেই, বিশেষ করে সেনাসদরে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। সেই সুযোগ ব্যাবহার করে বিভিন্ন পরিকল্পনা, তৎপরতার তথ্য গোপনে পাঠিয়ে দিতেন নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে।

মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য আর্থিক সহায়তা ছাড়াও বাটা এর কারখানা প্রাঙ্গনসহ টঙ্গীর বেশ কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এছাড়াও ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের সহায়তায় পাক বাহিনী কর্তৃক বাঙ্গালীদের উপর নৃশংস নির্যাতন গনহত্যার চিত্র গোপনে বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন গনমাধ্যমে পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ায় অসামান্য অবদান রাখেন।

২০০১ সালের ১৮ই মে ৮৩ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন এই বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা।

পন্ডিত রবি শংকর

সঙ্গীতের আকাশে অমলিন নক্ষত্র পন্ডিত রবি শঙ্কর জন্মেছিলেন ১৯২০ সালে ভারতের বেনারস-এ। ভাই উদয় শঙ্কর -এর নৃত্য দলের সাথে সমগ্র ইউরোপ ঘুরে কেটেছিলো তার কৈশোর। ১৯৩৮ সালে নৃত্য ত্যাগ করে হাতে তুলে নেন সেতার এবং ওস্তাদ আল্লাউদ্দিন খান এর ছত্রছায়ায় নিজেকে গড়ে তুলেন সেতারের মহারাজ হিসেবে।  


মুক্তিযুদ্ধে অসহায় মানুষের কান্নার ধ্বনির প্রতিধ্বনি করেছিলেন আপন সেতারায়। নিজে এসে দাঁড়ান বাঙ্গালীর পাশে এবং  বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে অনুরোধ করলেন বাংলাদেশের অসহায় মানুষের সাহাযার্থে এগিয়ে আসার জন্য। তার অনুরোধে রচিত জর্জ হ্যারিসনের বিখ্যাত গান 'বাংলাদেশ', যা গাওয়া হয়েছিল ১লা আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। রবি শঙ্করের সেতাররের সূরে হ্যারিসনের গাওয়া বাংলাদেশ গানটি বিশ্বের দরবারে বাঙ্গালীর দূর্বিষহ জীবনচিত্র তুলে ধরে।

১৯৭৩সালে জর্জ হ্যারিসনের সাথে যৌথভাবে  "The Concert for Bangladesh” এর জন্য Best Album of the year সহ এই মহাশিল্পী মোট  বার গ্র্যামি এওয়ার্ড-ভূষিত হন।

যার মধ্যে একটি ছিলো ২০১৩ সালে "Life TIme Achievement Award”. এছাড়াও ১৯৮৩ সালে তিনি একাডেমী অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হন।  

১৯৮৬-১৯৯২ সালে, ভারতের সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্য সভা- নির্বাচিত হন।১৯৯৯ সালে, ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা "ভারত রত্ন ভূষিত হন।

১১ই ডিসেম্বর ২০১২ ক্যালিফর্নিয়ায় চিরবিদায় নেন এই মহান ব্যক্তিত্ব।

জর্জ হ্যারিসন

১৯৪৩ সালে জন্ম নেয়া বিখ্যাত দ্য বিটেলস ব্যান্ডের সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সম্পর্কে পরিচিত না এমন বাঙ্গালি খুব কমই আছে। বাঙ্গালীর জন্য তেমন কাজও করেছিলেন বটে।

বন্ধু রবি শঙ্করের আহ্বানে এবং সহযোগিতায় আধুনিক সঙ্গীত ইতিহাসের সর্বপ্রথম মানবতার স্বার্থে অর্থ সংগ্রহকারী কন্সার্ট "The Concert for Bangladesh” আয়োজন করে বিশ্বে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেন। ৭১ এর ১লা অগাস্ট প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার- আয়োজিত এই কন্সার্টটিতে যুক্ত করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত লিয়ন রাসেল, বিলি প্রিস্টন, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপ্টন, রিঙ্গো স্টারের মত শিল্পীদের। অর্জিত প্রায় আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলারের পুরোটাই UNICEF এর সহযোগীতায় পৌছে দেন বাঙ্গালী শরণার্থীদের নিকট। ১৯৮৫ সালে Concert for Bangladesh অ্যালবাম চলচ্চিত্র থেকে অর্জিত ১২মিলিয়ন মার্কিন ডলার ত্রাণ হিসেবে পাঠিয়ে দেন এই দেশে।        

২৯শে নভেম্বর, ২০০১ সালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন আমাদের এই অকৃত্রিম বন্ধু।



আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ


১৯২৬ সালে নিউ জার্সি-তে জন্মগ্রহণ করা অ্যামেরিকান কবি আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ সর্বদাই ছিলেন একজন প্রতিবাদী কবি। তিনি আমরণ পুঁজিবাদী, সামরিকতন্ত্র, আমলাতন্ত্র এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গিয়েছেন। নিজ দেশের সরকারের বিপক্ষাবলম্বন সত্বেও মানবতার ডাকে এগিয়ে এসেছিলেন দেশের মানুষের সাহার্যার্থে। ৭১ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গিন্সবার্গ সেকালের পশ্চিমবঙ্গের কবি লেখক সুনীল গঙ্গপাধ্যায়ের বাড়িতে আসেন, পরবর্তীতে তাঁর সাথে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে নৌকায় করে পৌছান বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা যশোরে। ওখানকার শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসকারী মানুষের চরম দুর্দশা দেখে তাঁর বিবেক স্পর্শিত হয় এবং এই হতভাগ্য মানুষের মানবেতর অবস্থাকে তুলে ধরেন তার অমর কাব্যসেপ্টেম্বর অন যশোর রোডএর মাধ্যমে।


দেশে ফিরে বব ডিলানকে নিয়েসেপ্টেম্বর অন যশোর রোডকে গানে রূপান্তরিত করেন   আয়োজন করেন কনসার্টের। যার  আয়ের সম্পুর্ন অর্থ দান করেন বাংলাদেশী শরনার্থীদের সাহাযার্থে। কলকাতার শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক এর জনপ্রিয়যশোর রোডগানটি  ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডএরই বাংলা রূপান্তর।

কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেই নয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধের কালেও তিনি নিজ সরকারের বিরুদ্ধে কাব্যিক আন্দোলনের পাশাপাশি সশরীর আন্দোলনে যোগ দেন।

১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তী।

এডওয়ার্ড কেনেডি
টেড কেনেডি নামে পরিচিত মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের ভিসা না পেয়ে ভারতে বাংলাদেশী শরনার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে সেই তাদের মুখেই শোনেন পাক বাহিনী কর্তৃক এদেশে নিশংস হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষন আর অমানষিক অত্যাচারের করুণ কাহিনী। দেশে ফিরে তাঁর করা মন্তব্য উদ্ধৃত করে লন্ডন টাইমস লিখেছিলএটা মানবজাতির জন্য আমাদের সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি‘ 

সিনেটে শরণার্থীবিষয়ক জুডিশিয়ারি সাব কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- পূর্ব পাকিস্তানে গনহত্যা চলছে, রেডক্রস আন্তর্জাতিক কমিটির প্রতিনিধিদের শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়ার জন্য যেন পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। পূর্ববাংলা ভারতের সংকট নিয়ে সিনেটর কংগ্রেসের তিনি যে  সাত দফা সুপারিশ করেন তার মধ্যে ছিলো বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার জন্য ইসলামাবাদ সরকারকে চাপ প্রয়োগ এবং জাতিসংঘের সামনে পূর্ববাংলার ট্র্যাজেডি উপস্থাপন সহ আরো অনেক। 

৭২' যুদ্ধ পরবর্তী দেশে এসে তিনি পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা উৎপাটিত বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার বট গাছটি পুনঃরোপন করেন। দেশে ফিরেই তিনি মার্কিন সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য চাপপ্রয়োগ সহ শরণার্থী পুনর্বাসনে এবং পিএল ৪৮০-এর আওতায় খাদ্য-সহায়তা কর্মসূচি দ্রুত চালুর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানান।   


'গণতন্ত্রের আইকন’, ‘সিনেটের সিংহহিসেবে পরিচিত এডওয়ার্ড মুর কেনেডির ছিলেন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কনিষ্ঠ ভাই। জন্ম ১৯৩২সালে এবং ৭৭ বছর বয়সে  মৃত্যু ২৫ আগস্ট ২০০৯ সালে। তিনি দীর্ঘ ৪৭ বছর ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন। 


ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ

১০ অক্টোবর ১৯১১, ইংল্যান্ডের  লেস্টারে জীবনশুরু হয় এক দূর্ধর্ষ মহিলা সাংবাদিকের যিনি তাঁর সমগ্র জীবন পৃথিবীর বুকে সাহিসকতা সত্যপিপাসুর উদাহরণ হয়ে বেঁচে ছিলেন। ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে ভয়ঙ্কর সংবাদ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভ- ঘোষণা করা প্রথম সাংবাদিক। 


বিচিত্র অসনাতন সাংবাদিক জীবনের সক্রিয় ৭০টি বছর তাঁর কেটেছে রণাঙ্গন সংকটপূর্ণ স্থানে— 
মহাযুদ্ধকালের পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, রক্তাক্ত প্যালেস্টাইন, সাম্যবাদী চীন, আলজেরিয়া, এডেন, ভিয়েতনাম। 

যুদ্ধের হুঙ্কারে যখন সকলে নিরাপদে ছুটছে তখনই ক্লেয়ার ছুটে যান উল্টো দিকে, যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে।

ওয়ার হর্স উপাধিপ্রাপ্ত এই নারী সাংবাদিক নারীনিষিদ্ধ- এর কালে পুরুষদের ডিঙ্গিয়ে ফ্রন্টলাইনে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরেছিলেন যুদ্ধের ভয়ালচিত্র। ইহুদি সন্ত্রাসীরা কিং ডেভিড হোটেল উড়িয়ে দেয়ার কালে তিনি সেখানে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান, যেমনটি বাঁচেন ৭১ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের হামলা বিশ্ববাসীর নিকট বাঙ্গালীর দূর্দশা সাহসিকতার চিত্র উপস্থাপন করা প্রথম সাংবাদিকদের একজন ছিলেন ক্লেয়ার। দি ডেইলি টেলিগ্রাম এর এই সাংবাদিক যুদ্ধের সমগ্রসময়ই পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করেন এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে থাকেন যুদ্ধের চিত্র।

অমরত্বকে অসম্ভব প্রমাণ করে দিয়ে ১০৫ বছর বয়সে ১০জানুয়ারি ২০১৭ পরলোকগমন করেন এই উদ্বর্তী নারী।


No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Responsive Ads Here