এ নিয়ে সংশয় আছে অনেকের মধ্যে। এমনকি তাইওয়ানকে কি নামে ডাকা হবে তা নিয়েও।
খুব সহজ ভাবে বললে, চীন মনে করে তাইওয়ান তাদের দেশেরই অংশ। এটি চীন থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ। যেটি ভবিষ্যতে কোন একদিন চীনের সঙ্গে বিলুপ্ত হবে।
তাইওয়ান নিজেকে কিভাবে দেখে সেটার উত্তর অবশ্য এতটা সরল নয়। সেখানে কোন কোন দল এবং জনগণের একটি অংশ তাইওয়ানকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে চান। কেউ কেউ চীনের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পক্ষে।
আর জনগণের একটা বিরাট অংশ এখনো মনস্থির করে উঠতে পারেননি। তারা বরং তাইওয়ান এখন যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থাতেই থেকে যাওয়ার পক্ষে। অর্থাৎ চীনেরও অংশ নয়, আবার চীন থেকে আলাদাও নয়।
চীনের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান মূলত দক্ষিণ চীন সমূদ্রের একটি দ্বীপ। তাইওয়ান দ্বীপের মূল ভূখণ্ড ফুরমোজা (পর্তুগিজে ইলিয়া ফ়ুর্মোজ়া অর্থাৎ সুন্দরী দ্বীপ) নামেও পরিচিত যা পূর্ব এশিয়ার চীনা মূল-ভূখন্ড তীরবর্তী অঞ্চল এবং জাপানের মূল-ভূখন্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
এক সময় ওলন্দাজ কলোনি ছিল। তবে ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত চীনের রাজারাই শাসন করেছে তাইওয়ান। এরপর জাপানীরা দখল করেছে এই দ্বীপ।
জাপানের দখলের সময়পর্ব
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে জাপান তার সংস্কার আন্দোলন সম্পন্ন করার মাধ্যমে ধনতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে প্রবেশ করে । ১৮৯৪ সালে জাপান চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধায়। এটা ইতিহাসে ১৮৯৪ সালের চীন-জাপান যুদ্ধ নামে পরিচিত। চীনের ছিং রাজ সরকার পরাজিত হয় এবং ১৮৯৫ সালে জাপানের সঙ্গে শিমোনোসেকি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এটা দেশের অধিকারহরণের এক অপমানজনক চুক্তি ,যা অনুযায়ী, তাইওয়ান দ্বীপ এবং ফেংহু দ্বীপপূঞ্জকে জাপানের দখলে ছেড়ে দেয়া হয় । ফলে তাইওয়ান জাপানের উপনিবেশে পরিণত হয় এবং ৫০ বছর স্থায়ী জাপানী দখল শুরু হয়।
জাপান তাইওয়ান দখল করার পর থাইপেই শহরে গভর্নর-দফতর স্থাপন করে। এটাই তাইওয়ানে জাপানী শাসনের সর্বোচ্চ সংস্থা । তাছাড়া জাপানী পক্ষ তাইওয়ানের বিভিন্ন স্থানে থানা স্থাপন করে পুলিশ শাসন প্রবর্তন করে এবং তাইওয়ানে ঔপনিবেশিক শাসন ও “জাপানের রাজকীয় শিক্ষা” প্রবর্তন করে। একই সময়ে জাপান নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রথম দিকে তাইওয়ানকে তার কৃষি উন্নয়ন ও কৃষিজাত দ্রব্য প্রক্রিয়াকরণের একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে , তাতে তাইওয়ানের প্রক্রিয়াকরণ শক্তি ও পরিবহণ ব্যবস্থার ক্রমোন্নতি হয় । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালে জাপান তার সমরবাদী দক্ষিণমুখী আগ্রাসী অভিযানের জন্য তাইওয়ানে সামরিক বিষয় -সংক্রান্ত বিভিন্ন শিল্পের উন্নয়ন করেছে।
পুনরুদ্ধার এবং বিভক্তি
ইতিহাসের বাস্তব তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালে আন্তর্জাতিক চুক্তি পুনরায় তাইওয়ানকে চীনের ভূখণ্ডের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে । ১৯৪৩ সালের ১ ডিসেম্বর চীন, যুক্তরাষ্ট্র, আর ব্রিটেন তিন দেশের যৌথভাবে স্বাক্ষরিত “কায়রো ঘোষণায়” লিপিবদ্ধ করা হয় : “জাপান যে সব চীনা ভূখণ্ড জবরদখল করেছে, যেমন মাঞ্চুরিয়া, তাইওয়ান, ফেংহু দ্বীপপূঞ্জ ইত্যাদি চীনকে ফেরত দেয়া হয়।” ১৯৪৫ সালের ২৬ জুলাই চীন , যুক্তরাষ্ট্র , ব্রিটেন তিন দেশ এবং পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশগ্রহণে স্বাক্ষরিত “পোট্স্ড্যাম ইস্তাহারে” পুনরায় ঘোষিত হয় যে, “ কায়রো ঘোষণায় লিপিবদ্ধ ধারাগুলো অবশ্যই কার্যকরী করতে হবে।”
বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয় চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন চীনা সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয় দ্বীপটি।
কিন্তু চীনে মাও জেদং এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বাহিনির সঙ্গে যুদ্ধে হারতে থাকে চিয়াং কাইশেকের সরকার। চীনের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ হারায় তারা। এরপর চিয়াং কাইশেক আর তার কুওমিনটাং সরকারের লোকজন তখন পালিয়ে যায় তাইওয়ানে। সেখানে তারা ‘রিপাবলিক অব চায়না’ নামে এক সরকার গঠন করে। নিজেদেরকে সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার বলেও দাবি করে তারা।
কোন একদিন কমিউনিস্টদের কাছ থেকে আবার পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণ তারা নেবে, এমনটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা।
বহুদিন পর্যন্ত জাতিসংঘ থেকে বিশ্বের অনেক দেশ চিয়াং কাইশেকের সরকারকেই চীনের সত্যিকারের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজ অনেকের কাছে শুনতে অবাক লাগতে পারে, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কিন্তু তাইওয়ানের সরকারই চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছে।
কিন্তু ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ বেইজিং এর সরকারকেই চীনের আসল সরকার বলে স্বীকৃতি দিল। তারপর থেকে একে একে বিশ্বের প্রায় সব দেশই বেইজিং এর পক্ষ নিল, এবং তাইওয়ানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কমতে থাকলো।
১৯৮০'র দশক পর্যন্ত চীন আর তাইওয়ানের মধ্যে চলেছে তীব্র বাকযুদ্ধ। কিন্তু এরপর সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ‘এক দেশ, দুই পদ্ধতি’ নামে চীন এক প্রস্তাব দেয়। যেখানে তাইওয়ান মূল চীনে বিলুপ্ত হবে, কিন্তু তাদের স্বায়ত্বশাসন দেয়া হবে। কিন্তু তাইওয়ান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অবশ্য এর মধ্যে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকেনি।
২০০০ সালে তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন চেন শুই বিয়ান। ২০০৪ সালে তিনি ঘোষণা দেন যে তাইওয়ান চীন থেকে আলাদা হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়।
তার এই অবস্থান চীনকে ভীষণ রুষ্ট করে। ২০০৫ সালে চীন তড়িঘড়ি করে এক আইন পাশ করে। যাতে বলা হয়, তাইওয়ান যদি চীন থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে, সেটা ঠেকাতে চীন প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করবে।
তাইওয়ানের অর্থনীতি এখন চীনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ এখন আর স্বাধীনতাকে কোন বাস্তবসম্মত বিকল্প বলে ভাবে না।
তাইওয়ানের বড় দুই দলের মধ্যে ‘ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি’ এখনো অবশ্য স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যদিকে ''কুওমিনটাং পার্টি (কেএমটি)'' চায় মূল চীনের সঙ্গে একত্রীকরণ।
No comments:
Post a Comment